চোখ-দর্শনেন্দ্ৰিয় (Eye - Organ of Vision): চোখ এমন এক সংবেদী অঙ্গ যা আলোকের মাধ্যমে দৃষ্টি সঞ্চার করে। মানুষের চোখদুটি মাথার দুপাশে বহিঃকর্ণ ও নাসারন্ধ্রের প্রায় মধ্যবর্তী অংশে অবস্থিত। চোখ গোল অক্ষিগোলক- এ গঠিত। কয়েকটি আনুষঙ্গিক অঙ্গও চোখের সাথে জড়িত। চোখের মাত্র ট্রু অংশ বাইরে উন্মোচিত, বাকি অংশই কোটরের ভেতরে অবস্থান করে। চোখের পর্দায় অবস্থিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত রসে চোখ সিক্ত থাকে।
মানুষের চোখের বিভিন্ন অংশকে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন- অক্ষিগোলক (eye ball) ও আনুষঙ্গিক অঙ্গ।
অক্ষিগোলক (Eye ball):
মানুষের চোখ দেখতে গোল বলের মতো হওয়ায় অক্ষিগোলক নামে পরিচিত। প্রত্যেক গোলক তিনটি প্রধান অংশ নিয়ে গঠিত- A. অক্ষিগোলকের স্তর, B. লেন্স ও C.আই ব্রো/ভ্রু
A. অক্ষিগোলকের স্তর (Layers of Eye ball)
১. স্ক্লেরা (Sclera) বা স্ক্লেরোটিক স্তর (Sclerotic byer): এটি অক্ষিগোলকের বাইরের সাদা, অসচ্ছ ও সময় স্তর। এটি অস্বচ্ছ হলেও চোখের সামনের দিকে খুব কে মোনা ও স্বচ্ছ পর্দায় পরিণত হয়েছে। স্বচ্ছ পর্দাটির নাম (cornea)। কর্ণিয়াটি পুনরায় আরও একটি পাতলা পর্দা বা কনজাংটিভা (conjunctiva)-য় আবৃত। স্ক্লেরাচোখের আকৃতি রক্ষা করে, চোখকে সংরক্ষণ করে ও পেশি সংযুক্ত রাখে। কর্ণিয়ার মধ্য দিয়ে চোখের ভে প্রবেশ করে। কনজাংটিভা চোখকে ধূলাবালি ও জীবাণু থেকে রক্ষা করে।
২. কোরয়েড (Choroid) : এটি স্ক্লেরার নিচে অবস্থিত রক্তবাহিকাসমৃদ্ধ ও মেলানিন (melanin) রঞ্জকে রঞ্জিত স্তর। মেলানিন রঞ্জক থাকায় এটি কালো দেখায় রঞ্জক পদার্থ চোখের ভেতরে আলোর প্রতিফলনকে হ্রাস করে। রক্তবাহিকাগুলো চোখের কোষে পুষ্টি জোগায়, O2 সরবরাহ করে ও বর্জ্য অপসারণ করে।
আইরিশ ও কোরয়েডের সংযোগস্থলে অবস্থিত স্কুল বলয়াকার অংশ সিলিয়ারী বড়ি বা সিলীয় অঙ্গ। এটি সিলটি বলয় (ciliary ring), সিলীয় প্রবর্ধক (ciliary processes) ও সিলীয় পেশি (ciliary muscles) দিয়ে গঠিত। চোখের লেন্স সাসপেন্সরী লিগামেন্ট (suspensory ligament) দিয়ে সিলিয়ারী বডির সাথে যুক্ত। সিলীয় পেশিগুলো লেন্সের আকৃতি পরিবর্তন করে উপযোজন ক্রিয়ায় অংশ নেয়। সিলিয়ারী বডি অ্যাকুয়াস হিউমারও উৎপন্ন করে। লেন্সের চারদিক বেষ্টনকারী লিগামেন্টের নাম সাসপেন্সরী লিগামেন্ট। লিগামেন্টের অপর প্রান্ত সিলিয়ারী বড়ির সাথে যুক্ত থাকে। সাসপেন্সরী লিগামেন্ট দিয়ে লেপটি যথাস্থানে অবস্থান করে এবং সিলিয়ারী বডির সাথে যুক্ত থাকে। (কর্ণিয়ার পেছনে কোরয়েডের বাড়ানো অস্বচ্ছ, গোল ও মধ্য-ছিদ্রযুক্ত কালো রংয়ের পর্দাটির নাম আইরিশ) (iris)। এটি কর্ণিয়ার পেছনে ও লেন্সের সামনে অবস্থিত এবং দুধরনের অনৈচ্ছিক পেশিতে গঠিত। আইরিশ পেশির সংকোচন- প্রসারণ পিউপিলকে বড় ও ছোট করে, ফলে লেন্সে পরিমিত আলোর প্রবেশ নিশ্চিত হয়।
আইরিশের কেন্দ্রে পিউপিল (pupil) নামক একটি ছিদ্র থাকে। পিউপিলকে ঘিরে বৃত্তাকার ও অরীয় পেশি অবস্থিত। আলোকের তীব্রতা অনুযায়ী অরীয় ও বৃত্তাকার পেশির সংকোচন ও প্রসারণের সাহায্যে পিউপিলটি প্রয়োজন মতো ছোট-বড় করা যায়। অরীয় পেশি প্রসারিত হলে এবং বৃত্তাকার পেশি সংকুচিত হলে পিউপিল ছোট হয় এবং অরীয় পেশি সংকুচিত হলে ও বৃত্তাকার পেশি প্রসারিত হলে পিউপিল বড় হয়ে অক্ষিগোলকের ভেতরে আলোকের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করে। পিউপিলের মধ্য দিয়ে চোখে আলো প্রবেশ করে । মৃদু আলোতে পিউপিল বড় হয় এবং উজ্জ্বল বা তীব্র আলোতে পিউপিল ছোট হয়।
৩. রেটিনা (Retina) : এটি কোরয়েডের নিচে অবস্থিত এবং একমাত্র আলো - সংবেদী অংশ। এতে দুধরনের আলো- পবেদী কোষ আছে, যথা-রড (rod) ও কোন (cone) কোষ। রডকোষগুলো লম্বাটে ও রোডপসিন (rhodopsin) নামক প্রোটিনযুক্ত। কোনকোষগুলো কোণাকৃতি ও আয়োডপসিন ( iodopsin) নামক প্রোটিনযুক্ত। চোখে রডকোষ ও কোনকোষের সংখ্যা যথাক্রমে প্রায় বার কোটি পঞ্চাশ লক্ষ এবং সত্তর লক্ষ। কোনকোষগুলো উজ্জ্বল আলোতে দর্শনের রঙিন বস্তু দর্শনের জন্য এবং ছবির সঠিক বিশ্লেষণের জন্য উপযোগী। রডকোষগুলো অনুজ্জ্বল আলোতে (dim) ight) দর্শনের উপযোগী ।
তিন ধরনের কোনকোষ আছে বলে মনে করা হয়। প্রথম ধরনের কোনকোষ লাল রং, দ্বিতীয় ধরন সবুজ রং এবং রতীয় ধবন হলে সাদা রং দৃষ্ট হয়। রেটিনা বস্তুর প্রতিবিম্ব হট করে। রেটিনার সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অংশগুলো নিচে বর্ণিত হলো।
অন্ধবিন্দু (Blind spot) : অ্যাক্সনগুলো অক্ষিগোলকের যে বিন্দুতে মিলিত হয়ে অপটিক স্নায়ু গঠন করে, সে বিন্দুটি অন্ধবিন্দু । সেখানে কোনো রডকোষ বা কোনকোষ থাকে না, তাই আলোক সংবেদী নয় ।
ফোবিয়া সেন্ট্রালিস (Fovea centralis) : অন্ধবিন্দুর কাছাকাছি রেটিনার একটি অংশে প্রচুর কোনকোষ দেখা যায়, রডকোষ থাকে না। এ অংশ পীতবিন্দু (yellow spot) বা ফোবিয়া সেন্টালিস। এটি অতিরিক্ত আলো সংবেদী, তাই এখানে সবচেয়ে ভাল প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হয় ।
অপটিক স্নায়ু : রেটিনা স্তরে গ্যাংগ্রিওনসমৃদ্ধ নিউরনগুলোর অ্যাক্সনসমূহ একত্রিত হয়ে অপটিক স্নায়ু গঠন করে। রেটিনায় সৃষ্ট প্রতিবিম্ব অপটিক স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌছায়।
B. লেন্স (Lens):
পিউপিলের পেছনে অবস্থিত ও সিলিয়ারী বুড়ির সাথে বসপেন্সরী লিগামেন্টযুক্ত হয়ে ঝুলে থাকা একটি স্বচ্ছ স্থিতিস্থাপক ও ডিলে চাকতির মতো অংশকে লেন্স বলে । লেন্সতত্ত্ব ( lens fibres- নিউক্লিয়াসবিহীন সরু লম্বা কোষ) লেন্সের পেছনের চেয়ে সামনের তত বেশি চাপা, নরম ও কিছুটা হলুদ। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এটি আরো চাপা, হলদে ও দৃঢ় হয়, ফলে এর স্থিতিস্থাপকতা কমে যায় । তাপে রক্ত সরবরাহ নেই। সিলীয় পেশির সংকোচন-প্রসারণে লেন্স ও সংকুচিত প্রসারিত হয়। লেন্সের সাহায্যে আলোক রশ্মি বক্রতা প্রাপ্ত হয়ে রেটিনায় নিক্ষিপ্ত হয়। লেন্সের মাধ্যমে বস্তু থেকে আগত আলোক রশ্মি রেটিনার নির্দিষ্ট অংশে প্রতিফলিত হয়।
C. অক্ষিগোলকের গহ্বর বা প্রকোষ্ঠ (Chambers) অক্ষিগোলকে তরল পদার্থ পূর্ণ তিনটি গহ্বর বা প্রকোষ্ঠ আছে ।
অগ্র প্রকোষ্ঠ (Anterior chamber) : এটি কর্ণিয়া ও আইরিশের মধ্যবর্তী প্রকোষ্ঠ । এটি অ্যাকুয়াস হিউমার (aquous humour) নামক পানির মতো তরল পদার্থ দিয়ে পূর্ণ থাকে।
পশ্চাৎ প্রকোষ্ঠ (Posterior chamber) : এটিও অ্যাকুয়াস হিউমার দিয়ে পূর্ণ আইরিশ ও লেন্সের মধ্যবর্তি অবস্থানে থাকে।
ভিট্রিয়াস প্রকোষ্ঠ (Vitrious chamber) : এটি লেন্স ও রেটিনার মধ্যবর্তী বৃহৎ প্রকোষ্ঠ যা ভিট্রিয়াস হিউমার ভিটিয়াস হিউমার প্রকৃত পক্ষে ডিমের সাদা অংশের মতো ঘন কিন্তু স্বচ্ছ। ৯৯% পানি এবং ১% কোলাজেন (vitreous humour) নামক জেলির মতো স্বচ্ছ চটচটে পদার্থ দিয়ে পূর্ণ । হায়াল্যুরোনিক এসিড (hyaluronic acid) এ ভিট্রিয়াস হিউমার গঠিত। অ্যাকুয়াস হিউমার আলোর প্রতিসরণে সাহায্য করে, চোখের সম্মুখ অংশের আকৃতি ঠিক রাখে এবং লেন্স ও জোগায় । ভিট্রিয়াস হিউমার রেটিনার দিকে আলোর প্রতিসরণে সাহায্য করে এবং অক্ষিগোলকের আকৃতি বজায় রাখে।
চোখের আনুষঙ্গিক অংশ (Accessory Parts of Eye):
১. অক্ষিকোটর (Orbit) : এটি মস্তক ও মুখমন্ডলের অস্থি দিয়ে নািমত প্রাচীরে আবদ্ধ একটি ফাপা গর্তবিশেষ। এতে অক্ষিগোলক সুরক্ষিত থাকে।
২. অক্ষিপেশি (Eye muscles) : অক্ষিকোটরে (orbit) দুই শ্রেণির পেশি থাকে- এক্সট্রিনসিক ও ইন্ট্রিনসিক। যেসব পেশি অক্ষিগোলকের বাইরের দিকে অবস্থান করে তাদেরকে এক্সট্রিনসিক (extrinsic or extraocular) পেশি বলে। অপরদিকে যেসব পেশি অক্ষিগোলকের অভ্যন্তরে থাকে তাদের বলা হয় ইন্ট্রিনসিক (intrinsic) পেশি। আইরিশের পেশি ইত্যাদি ইন্ট্রিনসিক পেশির উদাহরণ। প্রতিটি অক্ষিগোলকের বাইরের দিকে সাতটি করে এক্সট্রিনসিক পেশি থাকে। এর মধ্যে ৪টি রেক্টাস (rectus), ২টি অবলিক (oblique) এবং ১টি লিভেটর পালপেত্রি সুপিরিওরিস (levator palpebrae superioris)। এসব পেশিতে করোটি স্নায়ু বিস্তৃত থাকে। পেশিগুলো অক্ষিগোলককে সঠিক স্থানে ধরে রাখে। তাছাড়া গোলককে বিভিন্ন দিকে ঘোরাতে এবং অক্ষিপল্লব উত্তোলনে সাহায্য করে। পেশিগুলো নিমরূপ :
ক. মিডিয়াল রেক্টাস (Medial rectus) : অক্ষিগোলককে অক্ষিকোটরের ভিতরের দিকে ঘুরতে সাহায্য করে।
খ. ল্যাটেরাল রেক্টাস (Lateral rectus) : অক্ষিগোলককে অক্ষিকোটরের বাইরের দিকে ঘুরতে সাহায্য করে।
গ. সুপিরিয়র রেক্টাস (Superior rectus) : অক্ষিগোলককে অক্ষিকোটরের উপর দিকে ঘুরতে সাহায্য করে।
ঘ. ইনফিরিয়র রেক্টাস (Inferior rectus) : অক্ষিগোলককে অক্ষিকোটরের নিচের দিকে ঘুরতে সাহায্য করে।
ঙ. সুপিরিয়র অবলিক (Superior oblique) : অক্ষিগোলককে অপটিক স্নায়ু ও কর্নিয়ার মধ্যবর্তী অক্ষ বরাবর ঘুরতে সাহায্য করে।
চ. ইনফিরিয়র অবলিক (Inferior oblique) : অক্ষিগোলককে সুপিরিয়র অবলিক পেশির বিপরীত দিকে ঘুরতে সহায়তা করে।
লিভেটর পালপেব্রি সুপিরিওরিস (Levator palpebrae superioris) : এ পেশি উর্ধ্ব অক্ষিপল্লবকে উপরে তুলতে সাহায্য করে। উপরোক্ত পেশিগুলো চোখকে অক্ষিকোটরের স্বস্থানে আটকে রাখে এবং অক্ষিগোলককে ঘুরতে সাহায্য করে।
উপরোক্ত পেশিগুলো চোখকে অক্ষিকোটরের স্বস্থানে আটকে রাখে এবং অক্ষিগোলককে ঘুরতে সাহায্য করে।
৩. অক্ষিপল্লব বা চোখের পাতা (Eyelid) : প্রত্যেক চোখের উপরে ও নিচে রোমযুক্ত পেশিবহুল পাতার মতো দুটি পর্দা থাকে। উপরেরটি উর্ধ্ব অক্ষিপল্লব ও নিচেরটি নিম্ন অক্ষিপল্লব। এছাড়া আরও একটি অক্ষিপত্র রয়েছে যা উপ-অক্ষিপল্লব বা নিকটিটেটিং পর্দা (nictitating membrane) নামে পরিচিত। এটি মানুষের একটি লুপ্তপ্রায় নিক্রিয় (vestigeal organ) অঙ্গ হিসেবে উভয় চোখের ভিতরের কোণায় অবস্থিত এবং দেখতে লালচে রঙের মাংসপিণ্ডের মতো। অক্ষিপল্লব ধূলাবালি, তীব্র আলো ও বাতাস থেকে চোখকে রক্ষা করে।
৪.অক্ষিপক্ষ (Eyelash) : চোখের পাতার লোমকে পিউপিল অক্ষিপক্ষ বলে। এগুলো চোখে ধূলাবালি প্রবেশে বাধা দেয়।
৫. আই ব্রো (Eye brow) : চোখের পাতার উপর অংশের লোমকে আই ব্রো বলে । কপাল থেকে গড়িয়ে আসা ঘামের চোখে প্রবেশ প্রতিহত করাই এর কাজ।
৬. অক্ষিগ্রন্থি (Eye glands) : চক্ষুতে বিদ্যমান রস ক্ষরণকারী কোষগুলোকে অক্ষিগ্রন্থি বলে। চক্ষুতে তিন প্রকার অক্ষিগ্রন্থি থাকে, যথা-
ল্যাক্রিমাল গ্রন্থি (Lacrimal gland) : এটি অক্ষি গোলকের অগ্রভাগের পৃষ্ঠদেশে অবস্থিত। এটি অশ্রু (tear) নামক এক প্রকার মৃদু লবণাক্ত জলীয় তরল ক্ষরণ করে যাতে ব্যাকটেরিয়ানাশক লাইসোজাইম (lysozyme) এনজাইম থাকে।
কাজ :এটি থেকে নিঃসৃত অশ্রু ধূলোবালি বিধৌত করে চক্ষুকে পরিষ্কার রাখে, কনজাংক্টিভাকে নরম ও আর্দ্র রাখে এবং কর্নিয়াকে পুষ্টি দেয়।
অশ্রুতে বিদ্যমান লাইসোজাইম ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস সুরক্ষা দেয়।
হার্ডেরিয়ান গ্রন্থি (Harderian gland) : এটি অক্ষিগোলকের পশ্চাৎভাগের অঙ্কীয়দেশে অবস্থিত। এক প্রকার পাতলা তৈলাক্ত রস ক্ষরণ করে।
কাজ : এর তৈলাক্ত ক্ষরণ অক্ষিপল্লব, কনজাংকিভা ও কর্নিয়াকে সিক্ত ও পিচ্ছিল রাখে।
মিবোমিয়ান গ্রন্থি (Meibomian gland) : এটি অক্ষিপল্লবের কিনারায় অবস্থিত এবং এক প্রকার গাঢ় তৈলাক্ত রস ক্ষরণ করে।
কাজ : এর তৈলাক্ত ক্ষরণ কনজাংক্টিভা ও কর্নিয়াকে পিচ্ছিল রাখে।
৭. কনজাংক্টিভা (Conjunctiva) : অক্ষিপল্লবের ভিতরের অংশ এবং স্ক্লেরার অগ্রাংশ (সাদা অংশ) যে স্বচ্ছ পাতলা মিউকাস স্তরে আবৃত থাকে তার নাম কনজাংটিভা। এটি চোখকে ধূলাবালি ও জীবাণু থেকে রক্ষা করে। চোখের সম্মুখতল এবং অক্ষিপরের ভিতরের তল আর্দ্র ও পিচ্ছিল রাখে।
প্রতিবিম্ব গঠন ও দর্শন প্রক্রিয়া (Formation of Image and Mechanism of Vision):
দর্শন প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল এবং পাঁচটি ধাপে সংঘটিত হয়, যথা-
*চোখে আলোর প্রবেশ।
*রেটিনায় প্রতিবিম্ব গঠন।
*প্রতিবিম্ব গঠনকারী রশ্মির বৈদ্যুতিক সিগন্যালে রূপান্তর।
*প্রতিবিম্ব সম্পর্কে স্নায়ু অনুভূতি (impulse) মস্তিষ্কে প্রেরণ।
*মস্তিষ্কের মাধ্যমে স্নায়ু অনুভূতির বিশ্লেষণ ও দর্শন।
Formation of Image
আমরা যে বস্তুকে দেখি, আলোকিত সে বস্তু থেকে আলোক রশ্মি প্রথমে কর্নিয়ার উপর পড়ে। স্বচ্ছ কর্নিয়ায় প্রতিসরিত আলোক রশ্মি পিউপিলের মাধ্যমে লেন্সে এসে পড়ে। দ্বিউত্তল লেন্স এ আলোক রশ্মিকে পুনরায় প্রয়োজনমত প্রতিসরণের মাধ্যমে রেটিনায় প্রতিফলিত করে। ফলে রেটিনার উপর বস্তুর একটি উল্টা প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হয়। রেটিনায় সৃষ্ট প্রতিবিম্ব রেটিনার আলোক সংবেদী কোষ (রডকোষ ও কোণকোষ)-কে উদ্দীপ্ত (simulate) করে। আলোক সংবেদী কোষের এ অনুভূতি বাইপোলার কোষ, গ্যাংলিয়ন কোষ এবং অপটিক স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে অপটিক লোবের দৃষ্টি কেন্দ্র বা ভিসুয়াল কর্টেক্স-এ পৌছায়। এ অঞ্চলে স্নায়ু অনুভূতি থেকে প্রাপ্ত উল্টা প্রতিবিম্বের তথ্য বিশ্লেষণ হয় ফলে মানুষ বস্তুটিকে সোজা দেখতে পায়।
দর্শন কৌশলের গতিপথ হচ্ছে–
আলোকরশ্মি → কর্নিয়া → অ্যাকুয়াস হিউমার → পিউপিল → লেন্স → ভিট্রিয়াস হিউমার → রেটিনা → অপটিক স্নায়ু → মস্তিষ্কের ভিসুয়্যাল কর্টেক্স।
উপযোজন (Accommodation)
দর্শনীয় বস্তু ও লেন্সের মধ্যকার দূরত্বের পরিবর্তন না করেই সিলিয়ারি পেশি ও সাসপেন্সরি লিগামেন্টের সংকোচন, এ লেন্সের বক্রতার তথা ফোকাস দূরত্বের পরিবর্তন ঘটিয়ে বিভিন্ন দূরত্বে অবস্থিত বস্তুকে সমান স্পষ্ট দেখার যে বিশেষ ধরনের পরিবর্তন ঘটে সে প্রক্রিয়াকে উপযোজন বলে। চোখ থেকে ৬ মিটার দূরত্বে অবস্থিত কোন বস্তুর প্রতিবিম্ব স্বাভাবিকভাবে রেটিনায় প্রতিফলিত হয়। এ দূরত্বের কম বেশি হলে বস্তুর প্রতিবিম্ব রেটিনায় মাসের জন্য উপযোজন প্রয়োজন । মানুষসহ বিভিন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণীতে উপযোজন একটি বৈশিষ্ট্য। এ সময় সিলিয়ারি বডিতে বিদ্যমান বৃত্তাকার পেশির সংকোচনের ফলে সাসপেনসরি লিগামেন্টের প্রসারণ ঘটে। ফলে লেন্সের বক্রতা বাড়ে ও খাটো হয়। লেন্সের ফোকাস দূরত্ব কমে গিয়ে কাছের বস্তুটি দৃষ্টিগোচর হয়। দূরের বস্তু দেখার সময় এর উল্টোটি ঘটে। অর্থাৎ, সিলিয়ারি বডির বৃত্তাকার পেশির প্রসারণ, সাসপেনসরি লিগামেন্টের সংকোচনে লেন্সের বক্রতা কমে, লেন্স সরু ও লম্বা হয় এবং ফোকাস দূরত্ব বেড়ে যায় এবং দূরের বস্তু থেকে আলোকরশ্মি রেটিনায় পতিত হয়ে প্রতিবিম্ব গঠন করে। তখন বস্তুটি দৃশ্যমান হয়। যে দৃষ্টিতে কাছের বস্তু স্পষ্ট দেখা যায় না তাকে হাইপারমেট্রোপিয়া (hypermetropia) বলে। উত্তল লেন্সের চশমা ব্যবহারে সমস্যার সমাধান হয়। যদি দূরের বস্তু দেখতে সমস্যা হয় তবে তাকে মায়োপিয়া (myopia) বলে। অবতল লেন্সের চশমা কাছের বস্তু দর্শন কৌশল দূরের বস্তু দর্শন কৌশল ব্যবহারে এ সমস্যা দূরীভূত হয়।
দ্বিনেত্র দৃষ্টি (Binocular vision) বা স্টেরিওস্কোপিক দৃষ্টি (Stereoscopic vision)
মানুষের দৃষ্টিকে দ্বিনেত্র দৃষ্টি বলে। কারণ আমরা কোনো দৃশ্যযোগ্য বস্তু একই সাথে দু’চোখের সাহায্যে এককভাবে দেখতে পাই। কোনো বস্তু থেকে প্রতিফলিত আলোকরশ্মি রেটিনায় পড়লে যে স্নায়ু উদ্দীপনার সৃষ্টি করে তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মস্তিষ্কের দৃষ্টিকেন্দ্রে (visual cortex) একটি মাত্র প্রতিবিম্বে একত্রীভূত হয়, ফলে আমরা দুচোখে একটি বস্তুকে এককভাবে দেখি। মানুষের চোখদুটি মাথার সামনে ৬.৩ সেন্টিমিটার দূরত্বে অবস্থিত। ফলে কোনো বস্তু দেখার সময় প্রত্যেক চোখ বস্তটির একটি করে প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করে। প্রতিবিম্ব দুটির একটি থেকে অন্যটি কিছুটা আলাদা। উভয় উদ্দীপনা মস্তিষ্কে প্রেরিত হয়। মস্তিষ্ক দুটি উদ্দীপনাকে সমন্বয় সাধন করে। ফলে বস্তুর একটি ত্রিমাত্রিক (three dimensional) চিত্র দেখা যায়।
দ্বিনেত্র দৃষ্টির শর্ত (Conditions of Binocular vision) :
• নির্দিষ্ট বস্তুতে নিবদ্ধ করার জন্য এভাবে দেখে অক্ষিপেশিকে সঠিকভাবে সংকুচিত হতে হবে।
• দুচোখের রেটিনায় সদৃশ বিন্দুর উপস্থিতি থাকতে হবে।
• দুচোখের রেটিনায় প্রায় একইরকম প্রতিবিম্বের সৃষ্টি হতে হবে।
• দুটি বীক্ষণক্ষেত্রকে এক জায়গায় পরস্পর মিলে যেতে হবে।
আরও দেখুন...